#### নারীদের প্রতি ডিজিটাল আগ্রাসন
নারী, বিশেষ করে রাজনৈতিক নেত্রীরা, এআই অপব্যবহারের প্রধান শিকার। এআই-এর মাধ্যমে তৈরি শ্লীলতাহানিমূলক ও বিভ্রান্তিকর কনটেন্ট তাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টি করছে। এম্পাওয়ারমেন্ট নেটওয়ার্ক বাংলাদেশের একটি জরিপে দেখা গেছে, ৭২% নারী অনলাইনে হয়রানির শিকার হয়েছেন, যার ৮২% ক্ষেত্রে এআই-এর মাধ্যমে তৈরি অশ্লীল ছবি ও ভিডিও জড়িত। এই কনটেন্ট ব্যক্তিগত নিরাপত্তার পাশাপাশি সমাজে বিভক্তি ও রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়াচ্ছে।
#### জাতীয় সংকটে অপতথ্যের প্রভাব
গত ১০ জুলাই সাভারে একটি মর্মান্তিক বাস দুর্ঘটনায় অসংখ্য প্রাণহানি ঘটে, যা দেশকে শোকাচ্ছন্ন করে। কিন্তু এই সময়ে এআই-এর মাধ্যমে তৈরি ভুয়া ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে, জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। তথ্য যাচাই সংস্থা ট্রুথগার্ড এই ভিডিওগুলোকে এআই-চালিত কল্পিত দৃশ্য হিসেবে শনাক্ত করেছে, যেখানে স্থানের বিবরণ এবং ভিজ্যুয়ালে ভুল ছিল। এই ঘটনা জাতীয় সংকটে এআই অপব্যবহারের ভয়াবহতা প্রকাশ করে।
#### প্রশাসনিক ও আইনি ঘাটতি
সরকার এআই অপব্যবহার রোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা রেজাউল করিম বলেন, “সাইবার নিরাপত্তা আইনে এআই অপব্যবহার রোধের বিধান থাকলেও, আইন প্রয়োগে দুর্বলতা এবং জনগণের সীমিত ডিজিটাল সচেতনতা এটিকে জটিল করে তুলেছে।”
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. ফারজানা আক্তার বলেন, “উন্নত দেশগুলো এআই অপব্যবহার রোধে উন্নত প্রযুক্তি ও নীতি প্রয়োগ করছে। বাংলাদেশেও নজরদারি ইউনিট গঠন এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধির উদ্যোগ জরুরি।”
যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রযুক্তি বিশ্লেষক আয়েশা সিদ্দিকী বলেন, “সোশ্যাল মিডিয়ায় এআই-চালিত অপতথ্যের বিস্তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। নারীদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল সহিংসতা রোধে কঠোর আইন, তথ্য যাচাই প্ল্যাটফর্ম এবং মিডিয়া সাক্ষরতা অপরিহার্য।”
#### সোশ্যাল মিডিয়ায় অপতথ্যের বিস্তার
সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, ফেসবুক, এক্স এবং ইউটিউবের মতো প্ল্যাটফর্মে ৯২% পোস্ট এআই রিকমেন্ডেশনের মাধ্যমে প্রচারিত হচ্ছে। গত ছয় মাসে অপতথ্যের হার ৩৫০ গুণ বেড়েছে, যা রাজনৈতিক অপপ্রচার এবং সামাজিক বিভাজনকে তীব্র করছে। ডিপফেক, সিন্থেটিক ভিডিও এবং ভয়েস ক্লোনিং প্রযুক্তির সহজলভ্যতা সাধারণ মানুষকেও বাস্তবসদৃশ ভুয়া কনটেন্ট তৈরির সুযোগ দিচ্ছে। প্রযুক্তিবিদরা আশঙ্কা করছেন, নির্বাচনের আগে ডিজিটাল সহিংসতা ও অপপ্রচার বহুগুণ বাড়বে।
#### আইনি ও নীতিগত শূন্যতা
বাংলাদেশে এআই অপব্যবহার নিয়ন্ত্রণে কোনো নির্দিষ্ট আইন নেই। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং নির্বাচন কমিশন কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা এআই-চালিত ভুয়া কনটেন্টকে অপরাধ হিসেবে ঘোষণা, ডিপফেক শনাক্তকরণে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার এবং সোশ্যাল মিডিয়া নজরদারির জন্য বিশেষ টিম গঠনের পরামর্শ দিয়েছেন।
ড. ফারজানা আক্তার বলেন, “কঠোর নজরদারি ছাড়া অপতথ্য নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। নির্বাচন কমিশনকে বিশেষ টিম গঠন করে ডিজিটাল স্পেস সুরক্ষিত করতে হবে।”
আয়েশা সিদ্দিকী যোগ করেন, “ফেসবুক, এক্স এবং ইউটিউবের মতো প্ল্যাটফর্মে কনটেন্ট নিয়ন্ত্রণ জোরদার করতে হবে। সরকারের উচিত এই প্ল্যাটফর্মগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে কঠোর নিয়ন্ত্রণ প্রয়োগ করা।”
#### ভবিষ্যৎ পদক্ষেপ
বিশেষজ্ঞরা এআই অপব্যবহার রোধে বহুমুখী পদক্ষেপের পরামর্শ দিয়েছেন:
- কঠোর আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন
- উন্নত তথ্য যাচাই ও ডিপফেক শনাক্তকরণ প্রযুক্তি প্রয়োগ
- প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে নজরদারি টিম গঠন
- জনগণের ডিজিটাল ও মিডিয়া সাক্ষরতা বৃদ্ধি
- সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে কার্যকর সমন্বয়
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক সতর্ক করে বলেন, “এআই-চালিত অপতথ্যের বৃদ্ধি নির্বাচনের আগে দেশকে বিশৃঙ্খলার দিকে ঠেলে দিতে পারে। তাৎক্ষণিক ও সমন্বিত পদক্ষেপ ছাড়া ডিজিটাল বিপর্যয় এড়ানো অসম্ভব।”
#### উপসংহার
বাংলাদেশে এআই প্রযুক্তির অপব্যবহার একটি গভীর সংকটে রূপ নিচ্ছে, যা সামাজিক স্থিতিশীলতা, রাজনৈতিক অখণ্ডতা এবং মানবাধিকারের জন্য হুমকি। সরকারের দ্রুত পদক্ষেপ এবং জনগণের মধ্যে ব্যাপক সচেতনতা ছাড়া এই সংকট মোকাবিলা অসম্ভব। অন্যথায়, আসন্ন নির্বাচন এবং দেশের ভবিষ্যৎ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এবং ডিজিটাল জগতে একটি বিপর্যয়কর সংকটের আশঙ্কা বেড়ে যাবে।