বিজ্ঞানীরা এমন এক ব্রেইন চিপ প্রযুক্তি উদ্ভাবনের দাবি করেছেন, যা মানুষের মনের কথা বা ভাবনা বুঝতে পারে। এই অগ্রগতি গুরুতর বাকশক্তি হারানো রোগীদের তাদের ভাবনা প্রকাশে সহায়তা করবে, যার ফলে তারা কথা বলতে না পারলেও যোগাযোগ স্থাপন করতে পারবেন।
এই গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে বিজ্ঞানভিত্তিক জার্নাল ‘সেল’-এ। গবেষণায় দেখা গেছে, এই নতুন ব্রেইন-কম্পিউটার ইন্টারফেস (বিসিআই) প্রযুক্তি ব্যবহারকারীর মনের ভাব বা কথা ৭৪ শতাংশ পর্যন্ত সঠিকভাবে ডিকোড করতে সক্ষম। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, এই প্রযুক্তি শ্রবণযোগ্য কথা বলতে অক্ষম ব্যক্তিদের জন্য সহজে ও স্বাভাবিকভাবে যোগাযোগের পথ উন্মুক্ত করবে।
স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির গবেষক এবং এই গবেষণার সহলেখক এরিন কুনজ বলেছেন, “এই প্রথম আমরা বুঝতে পেরেছি, মানুষ যখন শুধু কথা বলার কথা ভাবেন, তখন মস্তিষ্কের কার্যকলাপ কেমন হয়। যাদের কথা বলা বা নড়াচড়ায় গুরুতর সমস্যা রয়েছে, তাদের মনের ভাবনা পড়ে বা ডিকোড করে এই বিসিআই প্রযুক্তি তাদের আরও সহজে যোগাযোগ করতে সহায়তা করবে।”
এই বিসিআই প্রযুক্তি মস্তিষ্কের সেই অংশে ছোট সেন্সর বসিয়ে কাজ করে, যেখানে দেহের নড়াচড়া নিয়ন্ত্রিত হয়। এই সেন্সরগুলো মস্তিষ্কের সংকেত পড়ে এবং তা ব্যাখ্যা করে। ব্রিটিশ দৈনিক ইন্ডিপেনডেন্ট-এর প্রতিবেদন অনুসারে, উদাহরণস্বরূপ, যদি কারও হাত না থাকে কিন্তু সে মনে মনে ভাবে “আমি হাত নাড়াতে চাই,” তবে বিসিআই সেই ভাবনা ধরে নিয়ে একটি কৃত্রিম হাতকে নড়াচড়ায় সহায়তা করতে পারে।
সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, এই ব্রেইন চিপ এখন পক্ষাঘাতগ্রস্ত বা কথা বলতে অক্ষম ব্যক্তিদের ভাবনাও বুঝতে পারছে। যখন কেউ কথা বলার চেষ্টা করে, অর্থাৎ মুখের পেশি সক্রিয় করে শব্দ তৈরির চেষ্টা করে, তখন মস্তিষ্কের সংকেত বুঝে নিতে পারে এই চিপ। এমনকি কথাগুলো স্পষ্ট না হলেও, এই প্রযুক্তি তা ধরে লেখায় রূপান্তর করতে পারে।
গবেষণার আরেক লেখক বেনইয়ামিন মেশেডে-ক্রাসা বলেছেন, “যদি শব্দ না করে কেবল মনে মনে কথা ভাবলেই সেগুলো বোঝা যায়, তাহলে মানুষ আরও সহজে ও দ্রুত নিজের ভাব প্রকাশ করতে পারবে।”
গবেষণায় চারজন অংশগ্রহণকারীর মস্তিষ্কের মোটর কর্টেক্স বা কথা বলার স্নায়ুতে ছোট ইলেকট্রোড বসানো হয়েছিল। এদের মধ্যে কেউ অ্যামিওট্রফিক ল্যাটেরাল স্ক্লেরোসিস (এএলএস), ব্রেইনস্টেম স্ট্রোক বা গুরুতর পক্ষাঘাতে ভুগছিলেন। অংশগ্রহণকারীদের কথা বলার চেষ্টা বা কল্পনা করতে বলা হয়েছিল। গবেষণায় দেখা গেছে, কথা বলার চেষ্টা বা কল্পনার সময় মস্তিষ্কের অনেক অংশ একই রকমভাবে সক্রিয় হয়, তবে সংকেতগুলো যথেষ্ট ভিন্ন ছিল, যা বিজ্ঞানীরা সহজেই আলাদা করতে পেরেছেন।
বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, মনে মনে কথা ভাবার সময় মস্তিষ্কের সক্রিয়তা সামগ্রিকভাবে কিছুটা কম হয়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ব্যবহার করে এক লাখ ২৫ হাজার শব্দের শব্দভাণ্ডার থেকে মনে মনে ভাবা বাক্যগুলো ৭৪ শতাংশ সঠিকভাবে বুঝে বের করা সম্ভব হয়েছে। এমনকি অংশগ্রহণকারীদের বলা হয়নি এমন কথা, যেমন স্ক্রিনে থাকা গোলাপি বৃত্ত গোনার সময় মনে মনে ভাবা সংখ্যাগুলোও এই চিপ বুঝতে পেরেছে।
গোপনীয়তা রক্ষার জন্য গবেষকরা একটি পাসওয়ার্ড নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা তৈরি করেছেন, যা ছাড়া বিসিআই মস্তিষ্কের অন্তর্মুখী কথা বুঝতে পারবে না। উদাহরণস্বরূপ, যখন কেউ মনে মনে ‘চিটি চিটি ব্যাং ব্যাং’ ভাবেন, তখন এই বাক্যটি পাসওয়ার্ড হিসেবে কাজ করে এবং বিসিআই সক্রিয় হয়ে মনের কথা পড়া শুরু করে। পরীক্ষায় দেখা গেছে, এই পাসওয়ার্ডটি ৯৮ শতাংশের বেশি সঠিকতার সাথে চিহ্নিত করতে পেরেছে চিপটি।
গবেষণার আরেক লেখক ফ্রাঙ্ক উইলেট বলেছেন, “এই প্রযুক্তি নিয়ে আমরা সত্যিই আশাবাদী। ভবিষ্যতে বিসিআই এমন হবে, যা সাধারণ কথোপকথনের মতো স্বাভাবিক, সহজ এবং আরামদায়ক যোগাযোগের সুযোগ ফিরিয়ে আনবে।”
এই ব্রেইন চিপ প্রযুক্তি যোগাযোগের ক্ষেত্রে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করছে, বিশেষ করে যারা শারীরিক সীমাবদ্ধতার কারণে কথা বলতে বা নড়াচড়া করতে অক্ষম, তাদের জন্য এটি একটি বিপ্লবী পদক্ষেপ হতে পারে।